স্মার্টফোন কথা বলার সময় গরম হওয়ার কারণ এবং প্রতিকার
ভূমিকা
স্মার্টফোন বর্তমানে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। যোগাযোগ, বিনোদন, কাজকর্ম বা অনলাইন ক্রিয়াকলাপ—সবকিছুতেই স্মার্টফোন ব্যবহার করা হয়। তবে, স্মার্টফোন ব্যবহার করতে গিয়ে আমরা প্রায়ই একটি সাধারণ সমস্যার মুখোমুখি হই, বিশেষ করে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলার সময়: ফোন গরম হয়ে যায়। এটি অনেকের জন্য বিরক্তিকর এবং মাঝে মাঝে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
স্মার্টফোন গরম হওয়া একটি সাধারণ সমস্যা হলেও এর পিছনে কিছু নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। এই সমস্যার সমাধান এবং তা থেকে বাঁচার উপায় নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে এই আর্টিকেলে।
স্মার্টফোন গরম হওয়ার সাধারণ কারণসমূহ
স্মার্টফোন গরম হওয়ার কারণগুলো সাধারণত হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার উভয়ের ওপর নির্ভরশীল। নিচে কিছু প্রধান কারণ উল্লেখ করা হলো:
১. দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলা
অনেক সময় আমরা স্মার্টফোনে দীর্ঘ সময় ধরে কল করি। এ ধরনের দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহার স্মার্টফোনের প্রসেসর এবং ব্যাটারির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, যা ফোন গরম হওয়ার প্রধান কারণ হতে পারে। প্রসেসর বেশিক্ষণ সক্রিয় থাকলে এটি থেকে তাপ উৎপন্ন হয়, যা ফোনের গরম হওয়ার কারণ হতে পারে।
২. নেটওয়ার্কের সমস্যা
যখন কোনো এলাকায় নেটওয়ার্ক দুর্বল থাকে বা ফোনটি ক্রমাগতভাবে সিগন্যাল খুঁজতে থাকে, তখন প্রসেসর এবং রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি চিপ বেশি কাজ করে। এর ফলে ফোনের ব্যাটারি দ্রুত ক্ষয় হয় এবং তাপ উৎপন্ন হয়। দুর্বল সিগন্যাল এলাকায় ফোন গরম হওয়ার এই সমস্যা বেশি লক্ষ্য করা যায়।
৩. একাধিক অ্যাপ্লিকেশন বা প্রোগ্রাম চালানো
যদি ফোনে কথা বলার সময় একাধিক অ্যাপ্লিকেশন ব্যাকগ্রাউন্ডে চালু থাকে, তাহলে প্রসেসর এবং র্যামের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। এর ফলে ফোন অতিরিক্ত তাপ উৎপন্ন করে এবং গরম হয়ে যায়। অনেক সময় ফোনে ভারী গেম বা ভিডিও স্ট্রিমিং করার সময়ও এই সমস্যা হতে পারে।
৪. ব্যাটারির অতিরিক্ত চাপ
ফোনের ব্যাটারি দীর্ঘ সময় ধরে চার্জে রাখা, দ্রুত চার্জার ব্যবহার করা বা পুরনো ব্যাটারি থাকলে স্মার্টফোনের তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে। ব্যাটারি চার্জ হওয়ার সময় কথা বললে বা অন্যান্য কাজ করলে ব্যাটারির ওপর চাপ বাড়ে এবং ফলে গরম হয়ে যেতে পারে।
৫. ভল্টেজের সমস্যা
ফোন চার্জ করার সময় ভোল্টেজের অসামঞ্জস্যতা বা নিম্নমানের চার্জার ব্যবহার করাও ফোনের গরম হওয়ার একটি প্রধান কারণ। নিম্নমানের চার্জার বা ভোল্টেজের ফ্লাকচুয়েশন ব্যাটারি এবং প্রসেসরের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, যা ফোনের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
৬. সানলাইট বা বাইরের তাপমাত্রার প্রভাব
অনেক সময় সরাসরি সূর্যালোক বা উষ্ণ পরিবেশে দীর্ঘক্ষণ স্মার্টফোন ব্যবহার করলে ফোন গরম হয়ে যেতে পারে। বাইরের তাপমাত্রা ফোনের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দেয়, বিশেষ করে যদি ফোনের তাপ নির্গমন ব্যবস্থা ভালো না হয়।
৭. ফোনের কেসিং
অনেক সময় ফোনে ব্যবহৃত কেসিং ফোনের তাপ বেরিয়ে যেতে বাধা দেয়। ফোনের ভেতরের অংশ থেকে তাপ নির্গত হওয়া প্রয়োজন, কিন্তু কিছু কেসিং ফোনের তাপকে আটকে দেয়, ফলে ফোন দ্রুত গরম হয়ে যায়।
ফোন গরম হওয়া প্রতিরোধের উপায়
ফোন গরম হওয়ার সমস্যার সমাধানের জন্য কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এগুলোর মাধ্যমে ফোনের গরম হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
১. কলের সময় ফোন ব্যবহার সীমিত করা
দীর্ঘ সময় ধরে কল করা হলে ফোন গরম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই কল করার সময় ফোনের অন্য কাজগুলিকে সীমিত রাখা উচিত। যেমন, কথা বলার সময় ভারী অ্যাপ্লিকেশন বা গেম চালানো উচিত নয়। ব্যাকগ্রাউন্ডে অ্যাপ চলতে থাকলে সেগুলো বন্ধ করে রাখা ভালো।
২. ভালো মানের চার্জার ব্যবহার করা
ফোনের ব্যাটারির উপর অতিরিক্ত চাপ কমাতে এবং ফোন গরম হওয়া রোধ করতে অবশ্যই ভালো মানের চার্জার ব্যবহার করা উচিত। ফাস্ট চার্জার বা নিম্নমানের চার্জার ব্যবহার করলে তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে। তাই ফোনের মডেলের সাথে মানানসই চার্জার ব্যবহার করাই উত্তম।
৩. ফোনের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা
ফোন সরাসরি সূর্যালোকে বা উষ্ণ পরিবেশে ব্যবহার না করার চেষ্টা করতে হবে। দীর্ঘ সময় ধরে রোদে ফোন রাখলে বা গরম পরিবেশে ব্যবহার করলে ফোন গরম হতে পারে। এ কারণে ফোন শীতল স্থানে রাখা এবং সরাসরি সূর্যের আলো থেকে রক্ষা করা উচিত।
৪. ফোনের কেসিং ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা
যদি ফোনের কেসিং তাপ নির্গমন ব্যাহত করে, তাহলে সেই কেসিং ব্যবহার না করাই ভালো। ফোনের তাপ নির্গমন ব্যবস্থা ভালো থাকলে ফোনের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকবে এবং গরম হওয়ার সম্ভাবনা কমবে।
৫. সফটওয়্যার আপডেট করা
ফোনের অপারেটিং সিস্টেম এবং অ্যাপ্লিকেশনগুলো নিয়মিত আপডেট করা উচিত। অনেক সময় পুরনো সফটওয়্যার ব্যবহারে ফোনের প্রসেসরের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে এবং তা গরম হয়ে যায়। নিয়মিত আপডেট ফোনের পারফরমেন্স বাড়ায় এবং তাপ উৎপাদন কমায়।
৬. ব্যাকগ্রাউন্ড অ্যাপ্লিকেশন বন্ধ রাখা
প্রয়োজন না হলে ব্যাকগ্রাউন্ডে চলা অ্যাপ্লিকেশনগুলো বন্ধ রাখতে হবে। ব্যাকগ্রাউন্ডে অনেক অ্যাপ চলতে থাকলে প্রসেসর অতিরিক্ত চাপের কারণে গরম হতে পারে। ফোনের মেমোরি পরিষ্কার রাখাও গরম হওয়া রোধে সহায়ক হতে পারে।
৭. ফোনের র্যাম এবং স্টোরেজ ব্যবস্থাপনা
ফোনে যথেষ্ট পরিমাণে ফ্রি স্পেস রাখা উচিত। অতিরিক্ত ডেটা বা অ্যাপ জমে গেলে ফোনের প্রসেসর এবং স্টোরেজের ওপর চাপ পড়ে। স্টোরেজ পূর্ণ থাকলে ফোন ধীরে কাজ করে এবং গরম হয়ে যায়। তাই নিয়মিত অপ্রয়োজনীয় অ্যাপ ও ডেটা ডিলিট করা জরুরি।
ফোন গরম হলে কী করা উচিত
ফোন যদি অস্বাভাবিকভাবে গরম হয়ে যায়, তাহলে কিছু তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন:
১. ফোনকে বিশ্রাম দেওয়া
যদি ফোন অত্যধিক গরম হয়ে যায়, তাহলে প্রথমেই সেটিকে কিছুক্ষণ বন্ধ করে বিশ্রাম দেওয়া উচিত। এতে প্রসেসর ঠান্ডা হওয়ার সুযোগ পাবে এবং ফোনের তাপমাত্রা কমে যাবে।
২. চার্জ থেকে বিচ্ছিন্ন করা
ফোন চার্জ করার সময় যদি বেশি গরম হয়ে যায়, তাহলে সেটিকে চার্জ থেকে বিচ্ছিন্ন করা উচিত। অতিরিক্ত গরম অবস্থায় চার্জার যুক্ত থাকা ক্ষতিকর হতে পারে এবং ব্যাটারির স্থায়িত্ব কমাতে পারে।
৩. ভারী অ্যাপ বন্ধ রাখা
যদি গেম বা অন্যান্য ভারী অ্যাপ ব্যবহারের সময় ফোন গরম হয়ে যায়, তাহলে সেগুলো বন্ধ করে ফোনকে কিছুক্ষণ ঠান্ডা হওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত।
৪. ফোনের সফটওয়্যার রিসেট করা
ফোন যদি ক্রমাগত গরম হতে থাকে, তাহলে সেটির সফটওয়্যার রিসেট করার প্রয়োজন হতে পারে। অনেক সময় সফটওয়্যার বা অ্যাপের ত্রুটির কারণে ফোনের তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে। রিসেট করলে এই ত্রুটি দূর হতে পারে।
উপসংহার
স্মার্টফোন কথা বলার সময় বা অন্যান্য কাজ করার সময় গরম হয়ে যাওয়া একটি সাধারণ সমস্যা হলেও এর কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। ফোনের অতিরিক্ত গরম হওয়ার কারণগুলো বুঝে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ফোনের দীর্ঘস্থায়ী পারফরমেন্স নিশ্চিত করা যায়। আধুনিক স্মার্টফোনের ব্যবহারে আমরা কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে এই সমস্যা থেকে অনেকটাই মুক্তি পেতে পারি।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url